Site icon shadheenbangla

ইবাদতে মাইক ব্যবহার হারাম মনে করার কারণ ও তার বিশ্লেষণ

ইবাদতে মাইক ব্যবহার হারাম মনে করার কারণ ও তার বিশ্লেষণ

 

(ক) “ইবাদতে মাইক ব্যবহার করলে তা ইবাদাতের পরিবর্তন ঘটায়”

ইবাদতে মাইক ব্যবহার হারাম মনে করার একটা কারণ হচ্ছে “ইবাদতে মাইক ব্যবহার করলে তা ইবাদাতের পরিবর্তন ঘটায়” এই ধরনের চিন্তা।  বাহ্যিক দৃষ্টিতে এ কথার যৌত্তিকতা থাকলেও একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারব উক্ত কথাটি কতটুকু অযৌক্তিক ও বিভ্রান্তিকর। যেমন, আমাদের নবীজি (সা:) উত্তপ্ত গরমে খুব কষ্ট করে নামাজ আদায় করত। আর আমরা কত আরাম আয়েশের মধ্যে নামাজ আদায় করি, এটা কি ইবাদতের পরিবর্তন নয়?

নবীজি (সা:) লম্বা জামা পড়ে, কাপড় দিয়ে পাগড়ি বানিয়ে নামায আদায় করত। আর আমরা শার্ট পেন্ট ও মাথায় টুপি পড়ে নামায আদায় করি। ইহা কি ইবাদতের পরিবর্তন নয়?

আমার এই প্রশ্নগুলো অযৌক্তিক মনে হলেও এগুলোর যৌত্তিকতা রয়েছে যদি বিশ্বাস করি, ইবাদতে মাইক ব্যবহার করলে তা ইবাদতের পরিবর্তন ঘটায়। আসলে এই ধরনের বাহ্যিক পরিবর্তনকে ইবাদতের পরিবর্তন বুঝায়না। বরং ইবাদতের মধ্যে এমন কিছু সংযোজন ও বিয়োজনের করাকে বুঝায়, যা অপ্রয়োজনীয়, যাতে সওয়াবের আশায় করা হয় এবং যা সুন্নতের পরিপন্থী।

যেমন, ফজরের দুই রাকাত ফরজ নামাজ এক রাকাত বা চার রাকাত পড়লে অর্থাৎ কম বেশি করলে তা ইবাদতের পরিবর্তন বলে গণ্য হবে। কারণ এখানে সংযোজন বিয়োজন অপ্রয়োজনীয় এখানে সওয়াবের আশা করা হবে এবং সুন্নতের পরিবর্তনও ঘটবে। যেহেতু ফজরের ফরজ নামাজ দুই রাকাত আদায় করা সুন্নত।

এবার চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, ফজরের ফরজ নামাজ এক রাকাত বা চার রাকাত আদায় করলে ইবাদতের যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তা ইবাদতে মাইক ব্যবহারের কারণে লক্ষ্য করা যায়না। তাই বলা যায়, ইবাদতে মাইক ব্যবহার করলে ইবাদতের পরিবর্তন ঘটে এমন ধারণা বা বিশ্বাস অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন।

তাছাড়া ইবাদতে মাইক ব্যবহার করা হয় কেবল মাত্র ইবাদতের উপকরণ (Comforts) হিসেবে, ইবাদতের অংশ (Parts) হিসেবে নয়। যদি মাইক সওয়াবের উদ্দেশ্যে ইবাদতের অংশ (Parts) হিসেবে ব্যবহার করা হত, তবে অবশ্যই ইবাদতের পরিবর্তন ঘটেছে বলে গণ্য হত। এখন আপনার মনে ছোট একটি প্রশ্ন রয়ে যেতে পারে। তা হচ্ছে, ইবাদতের উপকরণ (Comforts) জিনিসটা কি?

উত্তর হলো, ইবাদত করার সময় তাতে ঐ জিনিসের ব্যবহার করা, যা ব্যবহারের মধ্যে সওয়াবের আশা করা হয়না, যা অপ্রয়োজনীয় নয় বরং শুধু মাত্র ইবাদত করার সুবিধার্থে হিকমা (Strategy) স্বরূপ ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তা ইবাদতের উপকরণ। যেমন, দ্বীনের দাওয়াত অন্যের নিকট পৌঁছানো একটি ইবাদত। আর কেউ যদি তা পত্রিকা, ফেসবুক, টুইটার, রেডিও,টেলিভিশন, ইত্যাদির সাহায্যে করে, তবে এসব হবে উত্ত ইবাদতের উপকরণ (Comforts)।

এভাবে, মসজিদ, মিনার, মাইক, ফ্যান ইত্যাদি সবই ইবাদতের উপকরণ। মনে রাখবেন পবিত্র কোরআন চামড়ায়, পাথর সহ বিভিন্ন মাধ্যমে সরক্ষণ করা হয়েছিলো। তাতে কোরআনের কোনো পরিবর্তন হয়নি।  অতএব, উপরের আলোচনা থেকে একথা জানতে পারলাম যে, ইবাদতে মাইক ব্যবহার হারাম নয়, ইবাদতে মাইক ব্যবহার করলে তাতে ইবাদতের কোনো পরিবর্তন ঘটেনা বরং মাইক ইবাদতের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয়।

লাউড স্পিকার কেবল এমন একটি মাধ্যম যা মুয়াজ্জিনের শব্দকে স্পষ্ট এবং সুন্দরভাবে বিপুল মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। প্রকৃতপক্ষে আজানের স্পষ্টতা এবং সৌন্দর্য উভয়ই শরিয়তে অত্যন্ত প্রস্তাবিত।

আবদুল্লাহ‌ ইবনু ইউসুফ (রহঃ) … আবদুল্লাহ‌ ইবনু আবদুর রহমান আনসারী মাযিনী (রহঃ) থেকে বর্ণিত, যে আবূ সায়ীদ খুদ্‌রী (রাঃ) তাঁকে বললেন, আমি দেখছি তুমি বক্‌রী চরানো এবং বন-জঙ্গলকে ভালবাস। তাই তুমি যখন বক্‌রী নিয়ে থাক, বা বন-জঙ্গলে থাক এবং সালাত (নামায/নামাজ)-এর জন্য আযান দাও, তখন উচ্চকণ্ঠে আযান দাও। কেননা, জ্বীন, ইনসান বা যে কোন বস্তুই যতদূর পর্যন্ত মুয়াযযিনের আওয়াজ শুনবে, সে কিয়ামতের দিন তার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে। আবূ সায়ীদ (রাঃ) বলেন, একথা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে শুনেছি। সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) নাম্বারঃ ৫৮২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৬০৯

আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ ….. নাজ্জার গোত্রের এক মহিলা সাহাবী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মসজিদে নববীর নিকটবর্তী ঘরসমূহের মধ্যে আমার বাড়ী ছিল সুউচ্চ। বিলাল (রাঃ) সেখানে উঠে ফজরের আযান দিতেন। তিনি সাহরীর শেষ সময়ে আগমন করে ঐ ছাদের উপর বসে সুবহে সাদকের অপেক্ষা করতেন। অতঃপর ভোর হয়েছে দেখার পর তিনি সোজা হয়ে দাঁড়াতেন এবং বলতেন, ইয়া আল্লাহ! আমি আপনার প্রশংসা করি ও সাহায্য কামনা করি এজন্য যে, আপনি কুরাইশদেরকে দ্বীন ইসলাম কায়েমের তৌফিক দান করুন। রাবী বলেন, অতঃপর বিলাল (রাঃ) আযান দিতেন। রাবী আরো বলেন, আল্লাহর শপথ! বিলাল (রাঃ) ঐ দুআ পাঠ কোন রাতেই বাদ দিয়েছেন বলে আমার জানা নাই। (আবু দাউদঃ 519)

বিলাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সমতলে না দাঁড়িয়ে বাড়ির ছাদে উঠে কেন আযান দিতেন? আযানের শর্তগুলোর মধ্যে একটা হলো আযানের আওয়াজ সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া। বর্তমানে বাড়ির ছাদে না উঠে মাইক বা লাউড স্পীকার ব্যবহার করা হচ্ছে, উভয়ের উদ্দেশ্য অভিন্ন।

Sultan Mosque- Singapore যে মসজিদে প্রথম মাইক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

(খ) মসজিদের ভিতর আযান দেয়া মাকরূহ” (ফাতহুল মুবীন,পৃষ্ঠা নং – ১)

যেসব লোকেরা ইবাদতে মাইক ব্যবহার হারাম মনে করেন, তার এটাও একটি কারণ যে, তারা বিশ্বাস করে মসজিদের ভিতর আযান দেয়াটা মাকরূহ। কারণ নবীজি (সা:) মসজিদের ভিতর কখনো আযান দেননি। তার সাহাবীগণ ও দেননি।তাই তারা মসজিদের ভিতর আযান দেয়াকে মাকরূহ মনে করেন। এখানে তাদের দলিল কোরান হাদিসের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা নয়।

বরং একটি খোড়া যুক্তি ও কিছু বিশেষজ্ঞদের মতামত। তাই আমি এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চাই। একথা সত্য যে, নবীজি (সা:) ও তার পরবর্তী সময়ে কোনো আলেম মসজিদের ভিতর আযান দেয়নি। তার কারণ, আযান দেয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য মুসল্লীদের নামাজের জন্য আহ্বান করা। কিন্তু এই আযান মসজিদের ভিতর দিলে অনেক মানুষই আযান শুনতে পারবেনা।

তাই মসজিদের বাইরে আযান দেয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শর্ত আযানের। ইহা বাদ দিলে আযানের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে। সুতরাং এ অবস্থায় মসজিদের ভিতর আযান দিলে তা আদৌ গ্রহণযোগ্য হবেনা। তাছাড়া সুন্নাহ থেকে আযানের নুন্যতম যে শর্তাবলী পাওয়া যায়, তার একটিও বাদ পড়লে আযানের হক আদায় হবেনা। শর্তগুলো হলো,

১। রাসূলুল্লাহ্ (সা:) শিখানো কালিমা গুলো বলতে হবে।

২। পুরুষ মানুষের কন্ঠে হতে হবে।
৩। মুসল্লীদের আযান শোনানোর যথাযথ চেষ্টা করতে হবে।
৪। আযান দেয়ার সময় ক্বিবলা মূখি হয়ে দাড়াতে হবে।

যেহেতু, মাইকের মাধ্যমে আযান দিলে উপরোক্ত শর্তাবলীর একটিও বাদ পড়েনা, তাই মাইক ব্যবহার হারাম কিংবা মাইক দিয়ে আযান দিলে মাকরূহ হবে, এমন ধারণা অবান্তর ও ভিত্তিহীন। যথাসম্ভব বেশী মুসল্লীদের কাছে আযানের আওয়াজ পৌছানোর জন্য তখন মিম্বার ব্যবহার করা হতো, বর্তমানে পরিধী আরও বেড়ে গেছে তাই মাইক ব্যবহার হচ্ছে। এখানে মূল উদ্দেশ্য মানুষের কাছে আযান পৌছানো, যেটা আযানে শর্ত।

(গ) “মাইকের আওয়াজ বক্তার আসল আওয়াজ নয়, তাই ইহার মাধ্যমে ইবাদত করা হারাম”

তার মানে এখানে আসল আওয়াজ ও নকল আওয়াজ নিয়ে বিতর্ক। এ বিতর্ক যে অযৌক্তিক ও অবান্তর তা বুঝানোর জন্য আমি কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করতেছি। ধরুণ, কেউ পাগড়ি পড়ে -কেউ টুপি পড়ে, কেউ সবুজ টুপি পড়ে- কেউ সাদা টুপি পড়ে, কেউ কাপড়ের টুপি পড়ে আবার কেউ প্লাস্টিকের টুপি পড়ে নামাজ আদায় করে এবং পাগড়ি বা টুপির এই পার্থক্যের কারণে যদি কোনো ফিতনা বা বিতর্কের সৃষ্টি হয়, তবে এই ফিতনা বা বিতর্ক মিটানোর জন্য আমাদের আসল বিষয়টিকে সামনে আনত হবে।

এখানে আসল বিষয় পাগড়ি বা টুপি এবং তাদের বর্ণ নয়, বরং আসল বিষয়টি হলো, রাসূল (সাঃ) সবসময় মাথা আবৃত বা ঢেকে রাখতেন এ কথাটাই। সুতরাং, কেউ যদি হালাল ও পবিত্র কিছু দ্বারা নিজের মাথা ঢেকে রাখে তবে তাতেই সুন্নত আদায় হয়ে যাবে। এটাই সঠিক পন্তা। এই উদাহরণ থেকে এই কথা বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে, মাইকের মাধ্যমে বের শব্দের আওয়াজ আসল না নকল তা আসল বিষয় নয়। বরং আসল বিষয় হচ্ছে, মাইকের মাধ্যমে বের হওয়া শব্দের অর্থ। মাইকের কারণে যদি শব্দের অর্থের কোনো পরিবর্তন না ঘটে, তবে অবশ্যই তা সঠিক ও সত্য বলে মেনে নিতে হবে এবং মাইক ব্যবহার হারাম নয়।

উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি, প্রায় ৬৮১ সালের পূর্ব সময় পর্যন্ত কোরআনের মধ্যে কোনো হরকত ছিলনা। পরে অনারব মুসলমানদের কুরান পাঠের সুবিধার জন্য উপকরণ স্বরূপ ৬৮১ সালে ইমাম হাজ্বাজ বিন ইউসুফ (রাজত্ব:ইরাক, ৬৬১-৭১৪ ইং) কোরানে হরকত সংযোজন করেন। তাই বলে এই কোরান নকল হয়ে গেছে কিংবা পরিবর্তন হয়ে গেছে এমনটা কেউ বলেনা। কারণ এখানে অর্থটাই আসল।

অর্থের কোনো পরিবর্তন হয়নি বলেই সকল আলেমেদ্বীন একমত যে, কোরানে হরকত সংযোজনে কোনো দোষ নেই। একই ভাবে মাইক দিয়ে কোরান পাঠ শোনালে এবং তাতে যদি অর্থের পরিবর্তন না ঘটে, তবে তা দ্বারা কুরআন পাঠ ও শোনা উভয় জায়েজ। এতে পৃথিবীর সকল বিশেষজ্ঞগণ একমত। কেবলমাত্র বিচ্ছিন্ন কিছু আলেমেদ্বীন ব্যতীত।

আমি এই বিচ্ছিন্ন আলেমেদ্বীন দের বিরোধিতাকে খারাপ বলিনা। কিন্তুু কেউ যদি এর কারণে কোরআনের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে অন্যদের কাফের কিংবা মুশরিক বলে দেয় এবং ফিতনার উদ্ভব ঘটায়, তবে আমি ইহাকে বিরোধীতার নামে চরম অজ্ঞতা বলি।

(ঘ) “মাইকের কারণে মুকাব্বির প্রথা বিলুপ্ত হচ্ছে যা রাসূল (সা:) এর সুন্নত “

আমি আবারও এ কথা স্বীকার করতেছি যে, মুকাব্বির দেওয়া সুন্নত, তবে তা প্রয়োজনের ভিত্তিতে অপ্রয়োজনে নয়। নবীজি (সা:) এর সময় যখন মসজিদে মুসল্লীদের সংখ্যা বেড়ে যেত, তখন পিছনের মুসল্লীরা ইমামের ক্বিরাত ও তাকবীর বলা কিছুই শোনতে পেতোনা। এতে নামাজে ইমামের অনুকরণ করে নামাজ আদায় করা সম্ভব হতোনা।

নামাজে ক্বিরাত না শোনলেও অন্তত ইমামের অনুকরণ করে রুকু-সিজদাহ বা উটা-বসা যাতে ইমামের সাথে করতে পারেন, সেজন্য রাসূল (সা:) মুকাব্বির প্রথার নিয়ম চালু করেন।

কিন্তুু নামাজে মাইক ব্যবহারের ফলে বর্তমানে মুকাব্বিরের প্রয়োজন নেই, তাছাড়া মুকাব্বির নামাজ কবুল হওয়ার কোনো শর্তও নয়। তাই ইহা বাদ দিলে নামাজের কোনো ক্ষতি হবে এমনটা বিশ্বাস করা ঠিক নয়।

তারপরও সুন্নত বর্জিত হয়েছে মনে করে অনেকেই এটা নিয়ে সংশয়ে থাকতে পারেন। তাই মনের সংশয় দূর করার জন্য একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে চাই। তা হলো, আমরা সকলেই জানি সময় মত নামাজ আদায় করা ফরজ। আর রাসূল (সা:) এই সময় নির্নয় করত সূর্য দেখে। এখন কি কেউ বলে ঘড়ি দেখে নামাজ পড়া হারাম?

আসলে সুন্নতের দোহাই দিয়ে মাইক ব্যবহার হারাম ও ঘড়ির মতো প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের উপকরণ থেকে দূরে থাকা সত্যিই গোড়ামির বহির্প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

(ঙ) “মাইক গান বাজনায় ব্যবহার করা হয় বলে ইবাদতে মাইক ব্যবহার হারাম”

এটা যে অবান্তর, অযৌক্তিক ও বিভ্রান্তিকর কথা তা অধিকাংশ মানুষই বুঝতে পারে। তবে যারা বুঝতে পারেনা বা বুঝার চেষ্টা ও করেনা তাদের জন্য দুটি প্রশ্ন রাখলাম,
১। আমরা মুখ দিয়ে অনেক সময় খারাপ কথা বলি, তাই বলে কি এই মুখ দিয়ে আল্লাহর নাম নেয়া হারাম?
২। মসজিদ আল্লাহর পবিত্র ঘর, তাই বলে কি ঘরে কাফেরদের তৈরি করা বাল্ব, ফ্যান, টাইলস, রং ইত্যাদি ব্যবহার করা হারাম?

(চ) “কোরআন মাজিদে এমন ১৪ টি আয়াত আছে যা শোনলে সিজদাহ দিতে হয় এবং সিজদাহ দেওয়া ওয়াজিব। কিন্তুু মাইকের কোরআন শোনলে অনেক মানুষ সিজদাহ দিতে পারেনা, তাই মাইক দিয়ে কোরআন পাঠ হারাম। তা হোক নামাজের ভিতরে বা বাইরে”

সিজদাহর আয়াত গুলো শোনলে তাতে সিজদাহ দেয়া ওয়াজিব। কিন্তুু কিভাবে শোনলে সিজদাহ দেয়া ওয়াজিব হয় তা আমরা রাসূল (সা:) এর সুন্নত এবং তার পরবর্তী সাহাবী, তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈ কাছ থেকে শিক্ষা পাই।

রাসূল (সা:) যখন সিজদাহর আয়াত গুলো পাঠ করতেন তখন সিজদাহ দিতেন আবার মাঝে মাঝে তা থেকে বিরত থাকতেন। এই বিষয়ে একটি দলিল হলো, সূরা ওয়ান নাজমে সিজদাহর আয়াত আছে অথচ নবীজি (সা:) কখনো কখনো সূরা ওয়ান নাজমুল পড়ে সিজদাহ দেননি। (সহীহ্ আল- বুখারি, খন্ডঃ ০২, হাদিস নং ১০১১-১২)

কোরআন শোনতে আসেনি বা কোরআন শোনতে অনিচ্ছুক ব্যক্তি যদি সিজদাহর আয়াত শোনে তবে তাকে সিজদাহ দিতে হবেনা। এই বিষয়ে ইমরান ইবনে হুসাইন (রা) জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, যে লোক কোরআন শোনতে আসেনি কিন্তুু সে সিজদাহর আয়াত শোনলে তাকে কি সিজদাহ দিতে হবে? উত্তরে তিনি উল্টো প্রশ্ন করে বলেন, বসলে্ও কি তাকে সিজদাহ দিতে হতো? তিনি আরও বলেন, আমরা এ জন্য আসেনি। তার মানে এই অবস্থায় সিজদাহ ওয়াজিব হয়না।

উসমান ইবনে আফ্-ফান(র) বলেন, যে মনোযোগ সহকারে সিজদাহর আয়াত শোনে তার উপর সিজদাহ ওয়াজিব হয়। আর সায়িব ইবনে ইয়াযিদ (র.) বক্তার বক্তৃতায় সিজদাহর আয়াত শোনে সিজদাহ করতেন না। (সহীহ্ আল বুখারি, খন্ড নং ০২,অনুচ্ছেদঃ৬৯২)

উমর ইবনে খাত্তাব (রা) জুমার খুতবায় বলেন, হে লোক সকল! আমরা যখন সিজদাহর আয়াত তেলাওয়াত করি তখন যে সিজদাহ করবে সে ঠিকই করবে। আর যে করবেনা তার কোনো গুনাহ নেই। বর্ণনাকারী বলেন, উমর (রা) সিজদাহ করেননি। নাফি (র) উমর (র) থেকে আরও বলেন, আল্লাহ তায়ালা সিজদাহ ফরজ করে দেননি। তবে আমরা ইচ্ছা করলে সিজদাহ দিতে পারি। (সহীহ্ আল বুখারি, খন্ডঃ০২, হাদিস নং ১০১৬)।

যে সব দলিলের অপব্যাখ্যা করে ইবাদতে মাইক ব্যবহার হারাম করার চেষ্টা করা হয়েছে।
যেভাবে কুরআনের অপব্যাখ্যা হয়ে থাকে :

আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে কুরআনের অপব্যাখ্যা হওয়ার ক্ষেত্রে যা হয় তা নিন্মে পয়েন্ট আকারে উল্লেখ করলাম,
১। কুরআনের আয়াতের প্রসংঙ্গ ছাড়া উদ্বৃতি দেয়া।
২। কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াতের বিপরীতে অস্পষ্ট আয়াত গুলোকে প্রধান্য দেয়া।
৩। কুরআনের পুরো আয়াতের কোনো নির্দিষ্ট অংশকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করে পুরো আয়াতের সামগ্রিক অর্থকে বাদ দেয়া। অথবা কয়েকটি আয়াতের সামগ্রিক অর্থকে বাদদিয়ে নির্দিষ্ট একটি আয়াতকে দলিল হিসাবে গ্রহণ করা।
৪। সাহাবি, তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈগণ কুরআনের অস্পষ্ট আয়াতের যে ব্যাখ্যা করেছেন তার বিপরীত ব্যখ্যা করা।

উপরোক্ত চারটি পয়েন্ট গুলো কুরআনের অপব্যাখ্যা হওয়ার জন্য যথেষ্ট ভুমিকা রাখে।
এবার আমি ‘ফাতহুল মুবীন‘ নামক বইতে ইবাদতে মাইক ব্যবহার হারাম কিংবা মাইক ব্যবহার শিরিক বলে কুরআনের যেসব আয়াতের উদ্বৃতি দেয়া হয়েছে তা ক্রমান্বয়ে বিশ্লেষণ করব ইন শা আল্লাহ।

# মাইক ব্যবহার হারাম দলিল : ১

আল্লাহ বলেন ,

…. ﻭﻧﺰﻟﻨﺎﻋﻠﻴﻚ ﺍﻟﻜﺘﺐ ﺗﻴﺒﻨﺎﻟﻜﻞ ﺷﻲﺀ ﻭﻫﺪﻱ ﻭﺭﺣﻤﺔ ﻭﺑﺸﺮﻱ ﻟﻠﻤﺴﻠﻤﻴﻦ

আর আমি আপনার প্রতি এই গ্রন্থ নাযিল করেছি যেটি এমন যে, তা প্রত্যেক বস্তুর
সুস্পষ্ট বর্ণনা, হিদায়াত, রহমত ও মুসলমানদের জন্য সুসংবাদ” (আলকোরান, সূরা নাহলে, আয়াত ১৬ :৮৯)। অর্থাৎ বিশ্বের মধ্যে এমন কোনো বস্তু নেই যা আল্লাহর কিতাবে উল্লেখ করা হয়নি। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত সৃষ্টির জ্ঞান সমূহ পবিত্র ক্বোরানের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং এখানে সুস্পষ্ট ভাবে মাইকের ব্যপারে ও আলোচনা করা হয়েছে। তাই যারা বলবে এ কুরআনে মাইক জায়িয বা নাজায়িয হওয়ার ব্যপারে কোনো স্পষ্ট আলোচনা করা হয় নাই, তারা কাফের। (ফাতহুল মুবীন, পৃষ্ঠা নং ১২-১৩ )

# বিশ্লেষণঃ একটি উদাহরণ দিয়ে আলোচনা টা শুরু করি, দুই বন্ধু, একজনের নাম বজলু অপর জনের নাম হাবলু। বজলু হাবলুকে জিজ্ঞাসা করে, ভাই হায়াত মউত আল্লাহর হাতে এটা কি বিশ্বাস করেন? হাবলু উত্তরে বলেন, হ্যাঁ। তখন বজলু হাবলুকে বল্ল, আপনি এই দশ তলা দালানের উপর থেকে লাফ দেন। হাবলু বল্ল, ঐখান থেকে লাফ দিলে আমি মারা যেতে পারি। তখন বজলু হাবলুকে বল্ল, আপনার আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস নাই, আপনি কাফের। এখানে বজলুর উদ্দেশ্য ছিল হাবলুকে কাফের বানানো। কারণ,সে জানে শুধু হাবলু নয় দুনিয়ার কোনো মানুষই তার কথায় ১০ তলা উপর থেকে লাফ দিবেনা। সুতরাং এমন কথা বলে বিভ্রান্তকারীরা।

উপরোক্ত আয়াত ও ব্যখ্যা দ্বারা তারাও মানুষদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করতেছে। কেননা, কোনো বস্তুর সুস্পষ্ট
বর্ণনা মানে, সে বস্তুটির নাম একবার হলেও উল্লেখ থাকবে। যেমনঃ মদ ও শূকর সম্পর্কে রয়েছে। অথচ তারা আয়াতটিকে এমন ভাবে ব্যখ্যা করেছে যে, মাইক শব্দটি কোরআনে না থাকলেও আছে বলে বিশ্বাস করতে হবে। আর যে বিশ্বাস করবেনা তাকে বাংলালিংক দামে কাফের বলে তাকফির করবে। তাছাড়া আয়াতের সঠিক অনুবাদও তারা করেনি।

উত্ত আয়াতটির অনুবাদের ক্ষেত্রে আরবি শব্দ ﺷﻲﺀ এর অনুবাদে ‘বস্তু’ শব্দটি ব্যবহারের চেয়ে ‘কিছু বা বিষয় ‘ এই শব্দ দুটি অধিক গ্রহণযোগ্য । আরবি ﺷﻲﺀ শব্দের ইংরেজি অর্থ হলো Thing যার similar word, topic, theme, article ইত্যাদি।

আর আরবি ﻛﻞ ﺷﻲﺀ এর অর্থ ইংরেজি Everything এবং বাংলায় সবকিছুই বা সববিষয়ই। কেননা, বাংলা ‘বস্তু’ শব্দটি দ্বারা শুধু মাত্র জিনিসকে বুঝায়। কিন্তু ‘কিছু বা বিষয়’ শব্দ দুটির ব্যাপ্তি অনেক বেশি।

ﻭﻧﺰ ﻟﻨﺎ ﻋﻠﻴﻚ ﺍﻟﻜﻴﺘﺐ ﺗﻴﺒﻨﺎ ﻟﻜﻞ ﺷﻲﺀ
আয়াতটির উত্ত অংশের সঠিক অনুবাদ ও ব্যখ্যা হচ্ছে, “আর আমরা নাযিল করেছি তোমার প্রতি কিতাবটি,যা সববিষয়ের ব্যখ্যা …” এর মানে, এমন সব বিষয়ের ব্যখ্যা কোরানে আছে বুঝানো হয়েছে, যা দ্বারা হেদায়েত ও গোমরাহী, লাভ ও ক্ষতি এবং হক ও বাতিলের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য করা যায়। অথবা আগত অনাগত সব সমস্যার সমাধান করা যায়।

অন্য ভাবে বললে, কোরআনে এমন সুস্পষ্ট মূলনীতি বর্ণনা করেছে যে মূলনীতির ভিত্তিতে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে। যেমনঃ মাইক, কম্পিউটার, মোবাইল, ফেসবুক, সিগারেট ইত্যাদি।

# ইবাদতে মাইক ব্যবহার হারাম দলিল : ২

আল্লাহ বলেন,

ﻭﺇﺯﺍﻗﺮﻯﺀﺍﻟﻘﺮﺍﻥ ﻓﺎﺳﺘﻤﻴﻌﻮﺍﻟﻪ ﺍﻧﺼﺘﻮ ﺍﻟﻌﻠﻜﻢ ﺗﺮﺣﻤﻮﻥ

আর যখন কোরান পাঠ করা হয় তখন তাতে কান লাগিয়ে রাখ এবং নিশ্চুপ থাক, যাতে তোমাদের উপর রহমত করা হয় ” (আলকোরান, সূরা আরাফ, আয়াতঃ ০৭/২০৪)।

উত্ত আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে “কোরান তেলাওয়াতের সময় দু’টো কাজ ফরজ, কান লাগিয়ে শোনা এবং নিশ্চুপ থাকা। যেখানে লোকজন শোয়ায়েব অথবা নিজ নিজ কাজ কর্মে মশগুল রয়েছে ঐ স্থানে উচ্চস্বরে কোরান তেলাওয়াত করবেনা, কারণ এতে লোকজনের কাজ কর্মের ক্ষতি হবে, উপরন্তু যারা চুপ রইবেনা তারা গুনাহগার হবে “(তাফসিরে রুহুল মা’নী) এই কারণে মাইকের সাহায্যে তারাবির নামাজ, সবীনা খতম ইত্যাদি কখনো পড়া যাবেনা।

কেননা, মানুষ নিদ্রা না যাওয়া দরুণ অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাছাড়া মাইকের ধ্বনি বিকৃতি হওয়ার কারণে খারাপ আওয়াজের সৃষ্টি হয় (যা পবিত্র কোরআনের শানে বেইজ্জতি হয়)। মাইকের তেলাওয়াতে সিজদাহর আয়াত সমস্ত শহরবাসী শ্রবণ করে কিন্তু কেউ সিজদাহ আদায় করেনা। এই যে (আল্লাহর হুকুম) ফরজ লংঘন করা হচ্ছে তা কত বড় জগণ্য গুনাহ চিন্তা করে দেখুন ” (ফাতহুল মুবীন, পৃষ্ঠা নং ১৩,১৪,১৫,)।

#বিশ্লেষণঃ এখানে আমি সেই তাফসীর উল্লেখ করেছি যা ফাতহুল মুবীন নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে।
কোরআনের আয়াতটির ব্যখ্যা স্বরুপ তারা দুটি কথা বলেছে,
১। কোরআন পাঠের সময় কান লাগিয়ে শোনা।
২। কোরআন পাঠের সময় চুপ থাকা।

এই দুটি কথা ছাড়াও তারা অনেক কথাই বলেছে যা উত্ত আয়াতের সাথে প্রাসঙ্গিক না হলেও মাইকের মাধ্যমে কোরআন পাঠ করা হারাম হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

যেমনঃ (১) মাইকের মাধ্যমে কোরআন পাঠ করলে নিদ্রার ডিস্টার্ব হওয়ার দরুণ অসুস্থ হওয়া।
(২) মাইকে সি..সি.. আওয়াজের কারণে কোরআন বিকৃতি হওয়া, এবং
(৩) মাইকে কোরআন পাঠের মাধ্যমে সিজদাহর আয়াত শোনলে সিজদাহ না করা।

শেষের এই তিনটি বিষয় নিয়ে আমি এই আয়াতের আলোচনা শেষে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। যেহেতু এগুলো উত্ত আয়াতের সাথে প্রাসঙ্গিক নয়। উত্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তারা কোরান পাঠ শোনা এবং কোরান পাঠের সময় চুপ থাকাকে ফরজ বলেছেন।

অথচ কোরানের এই আয়াতটি একটি সাধারণ আয়াত যা মুসলমানদের কোরআনের মজলিসে বসাকালীন অবস্থায় কোরআন মনোযোগ সহকারে নিশ্চুপ ভাবে শোনার নির্দেশ দিচ্ছে। যেমনটি বিবাহ, তাহাজ্জুদের নামাজ ইত্যাদি সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর এসব সাধারণ নির্দেশ কেবল মাত্র সময় ও অবস্থার  ভিত্তিতে ফরজ হতে পারে।

নিম্নে কোরআনের আয়াতটি উল্লেখ পূর্বক তার ব্যখ্যা ও শিক্ষা আলোচনা করতেছি।
আল্লাহ বলেন,

ﻭﺇﺯﺍﻗﺮﻯﺀﺍﻟﻘﺮﺍﻥ ﻓﺎﺳﺘﻤﻴﻌﻮﺍﻟﻪ ﺍﻧﺼﺘﻮ ﺍﻟﻌﻠﻜﻢ ﺗﺮﺣﻤﻮﻥ

আর যখন কোরআন পাঠ করা হয় তখন তোমরা তার দিকে মনোযোগ আরোপ করে শোন এবং নিশ্চুপ থাক। যাতে তোমরা দয়া বা উপদেশ গ্রহণ করতে পার”

অর্থাৎ যারা কোরান পাঠ শোনতে গিয়ে মনোযোগ সহকারে শোনেনা, নিশ্চুপও থাকেনা তারা যেন মনোযোগ সহকারে শোনে এবং নিশ্চুপ থাকে। যদি তারা এরূপ করে তবে অবশ্যই তারা কোরআন বুঝবে এবং তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে পারবে।

যেমন, ওয়াজ মাহফিল বা খুতবায় যখন কোরআন পাঠ করা হয় তখন যারা শোনতে যাবে তারা নিরবে মনোযোগ সহকারে শোনবে এটাই আল্লাহর নির্দেশ। আর শোনতে ইচ্ছে না হলে অন্যদের ডিস্টার্ব না করে মজলিস ত্যাগ করবে।

কিন্তু এই আয়াতের অর্থ এমন নয় যে, কেউ দূর থেকে বা কাছ থেকে কোরআন পাঠ শোনতে পেল তাই তাকে অবশ্যই কান লাগিয়ে মনোযোগ সহকারে শোনতে হবে, না হলে পাঠক বা শ্রুতার গুনাহ হবে এমন কথা বা বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।

কেননা, আমরা জানি কোরআন পাঠ করা বা শোনা উভয় নফল ইবাদত ফরজ বা ওয়াজিব নয়। ইহা সময় ও কাজের ভিত্তিতে ফরজ ওয়াজিব হতে পারে, তাই বলে কেউ ইহাকে ঢালাও ভাবে বলতে পারেনা যে, কোরআন পাঠ করা বা শোনা ফরজ।

আশা করি উত্ত আয়াতের সঠিক ব্যখ্যা ও শিক্ষা অনুধাবন করাতে সক্ষম হয়েছি। এবার শেষের কারণ তিনটি সংক্ষেপে আলোচনা করতেছি,

(১) মাইকের মাধ্যমে কোরআন পাঠ করলে নিদ্রার ডিস্টার্ব হওয়ার দরুণ অসুস্থ হওয়া:

প্রয়োজনে যখন মাইকে ওয়াজ মাহফিল বা কোরআন পাঠ করা হয়, তখন কোনো ব্যক্তি বিশেষের ওজর কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। যদিনা ওজরটা একেবারেই আবশ্যিক না হয়। উদাহরণ স্বরুপ বলতে পারি, জুমার খুতবা দেয়ার সময় যদি কোনো লোক দুখুলুল মসজিদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করে তবে এই জন্য ইমাম খুতবা বন্দ করে
দিবেনা।

(২) মাইকে সি..সি..আওয়াজের কারণে কোরআনের বিকৃতি হওয়া :

যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অনেক সময় মাইকে সি..সি.. আওয়াজ করে তাতে কোরআন বিকৃতি হয়ে যায় এবং কোরআনের বেইজ্জতি হয় এমন কথা ভিত্তিহীন ও ভ্রান্ত। কোরআন বিকৃতি হবে তখন যখন তাতে কম বেশি করা হবে। আজকাল দেখি, ইমাম যখন মাইক ছাড়া ক্বিরাত পড়ে তখন মসজিদের বৈদ্যুতিক ফ্যানের আওয়াজে ইমামের ক্বিরাত পিছনের অনেক মুসল্লি শোনতে পান না, যারা শোনতে পান তারা ফ্যানের সা..সা.. আওয়াজসহ শোনতে পান।

কই কেউতো বলেনা, এই জন্য মসজিদে ফ্যান ব্যবহার করা হারাম এবং তাতে কোরআনের বিকৃতি ঘটে। পত্রিকা যখন পুরনো হয়ে যায় তখন তা রাস্তা ঘাটে পড়ে থাকে। কই কেউতো বলেনা, এতে কোরআনের বেইজ্জতি হয় তাই পত্রিকার মাধ্যমে দ্বীন প্রচার করা হারাম।

(৩) মাইকে কোরআন পাঠে সিজদাহর আয়াত শোনলে সিজদাহ না দেওয়া এই বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তাই আবার আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করলাম না।

# মাইক ব্যবহার হারাম দলিল : ৩

আল্লাহ বলেন,

ﻭﻻ ﺗﺠﻬﺮ ﺑﺼﻼﺗﻚ ﻭﻻﺗﺨﺎ ﻓﺖ ﺑﻬﺎ ﻭﺍﺑﺘﻎ ﺑﻴﻦ ﺫﻟﻚ

ﺳﺒﻴﻼ ‏( ﺑﻨﻲ ﺍﺳﺮﻳﻞ )

আর স্বীয় নামাজ খুব উচ্চস্বরে ও পড়বে না এবং চুপে চুপে ও পড়বেনা, বরং উভয়ের মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর।”(আলকোরান, সূরা, বনি ইসরাঈল, আয়াত :১৭/১১০)।

এই আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে প্রখ্যাত তাফসীরে নুরুল ইরফান স্পষ্ট ঘোষণা দিচ্ছে :”এ কারণে, বা এ আয়াত দ্বারা মাইকে নামায পড়া নিষেধ ” (ফাতহুল মুবীন,পৃষ্ঠা নং ১৬, ১৭)। এ কারণে ফাতহুল মুবীন গ্রন্থের লেখক মুহাম্মদ বশির উদ্দীন আহমদ আলত্বাফী তার গ্রন্থে নামাজে মাইকের ব্যবহারকে হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছে “।

#বিশ্লেষণঃ উত্ত তাফসির ও ফতোয়া দেখে মনে হচ্ছে, রাসূল (সা:) এর যুগে মাইক ছিল এবং নামাযে মাইক ব্যবহার করাতে আল্লাহ তাকে মাইক ব্যবহার করতে নিষেধ করেছে। আসলে কি তাই? রাসূল (সা:) এর যুগে কি মাইক ছিল?

তিনি কি নামাযে মাইক ব্যবহার করতেন? যদি তা না হয় তবে কোন প্রেক্ষাপটে এ আয়াত নাযিল হয়েছে তা না জেনে কিভাবে এই ফতোয়া দিল তা সত্যিই ভাববার বিষয়। এখানে এই আয়াতের প্রেক্ষাপটসহ আলোচনা করা উচিত ছিল। যেহেতু এ আয়াত দ্বারা যে জিনিসটাকে সরাসরি হারাম বলে ফতোয়া দিচ্ছে তা আয়াতটি নাযিলের সময় বিদ্যমান ছিলনা।

নিম্নে আমি এ-আয়াতটি নাযিলের প্রেক্ষাপট বা শানেনুযুলসহ আলোচনা করতেছি,

ﻭﻻ ﺗﺠﻬﺮ ﺑﺼﻼﺗﻚ ﻭﻻﺗﺨﺎ ﻓﺖ ﺑﻬﺎ ﻭﺍﺑﺘﻎ ﺑﻴﻦ ﺫﻟﻚ

ﺳﺒﻴﻼ ‏( ﺑﻨﻲ ﺍﺳﺮﻳﻞ )

আর স্বীয় নামাজ উচ্চস্বরে ও পড়বেনা এবং চুপে চুপে ও পড়বেনা, বরং উভয়ের মধ্যপন্থা অবলম্বন কর “

বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, যখন মুসলমানগণ নামাযে উচ্চস্বরে কোরআন পাঠ করেন তখন কাফেররা কোরান যিনি নাযিল করেন, যার মাধ্যমে নাযিল করা হয় এবং যার উপর নাযিল হয় তাদের সকলকে গালি দিত, তখন এ আয়াত নাযিল হয় “আর স্বীয় নামাজ উচ্চস্বরে ও পড়বেনা এবং চুপেচুপে ও পড়বেনা, বরং উভয়ের মধ্যপন্থা অবলম্বন কর “(সহীহ্ আল বুখারি, খন্ড :০৮, হাদিস নং ৪৩৬৩, সহীহ্ মুসলিম, খন্ড :০২ হাদিস নং ৮৯৬)।

এই হুকুমটি উক্ত গঠনার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। মদিনায় আসার পর তা আর কার্যকর ছিলনা বলে অনেক তাফসিরকারকগণ মত প্রকাশ করেন। তাছাড়া, প্রেক্ষাপট অনুসারে যদি এই আয়াতটি নিয়ে মনোযোগ সহকারে চিন্তা করা হয়, তবে এ আয়াত থেকে দুটি নির্দেশ পাওয়া যায়।

১।  নামাযের মধ্যে এমন উচ্চস্বরে কোরান পাঠ করবেনা, যাতে বাহিরের শত্রুরা শুনতে পায়। আবার এমন নিম্নস্বরেও পড়বেনা, যাতে মুসল্লীগণ কোরান পাঠ শুনতে না পায়। অর্থাৎ যেখানে শত্রুর ভয় রয়েছে, সেখানে এ দুই নির্দেশ মেনে চলতে হবে অথবা প্রেক্ষাপট অনুসারে শুধু প্রথম নির্দেশ। আর যেখানে শত্রুর ভয় নেই সেখানে দ্বিতীয় নির্দেশ যথাযথ ভাবে মেনে চলতে হবে।

এখানে দ্বিতীয় নির্দেশ মানে, উপস্থিত মুসল্লীরা শুনে মতো ক্বিরাত পড়তে হবে।  এটাই আল্লাহর বিধান। অর্থাৎ মুসল্লীদের সংখ্যা বেশি হলে মাইকও ব্যবহার করাও জায়েজ ।

 

#মাইক ব্যবহার হারাম দলিল : ৪,৫

আল্লাহ বলেন,

ﻭﺍﻋﺒﺪﻭ ﺍﻟﻠﻪ ﻭﻻ ﺗﺸﺮ ﻛﻮﺍﺑﻪ ﺷﻴﺌﺎ ‏( ﺍﻟﻨﺴﺎﺀ )

আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, আর তার সাথে কোনো বস্তুকে শরীক করোনা” (আলকোরান, সুরা নিসা, আয়াত :০৪/৩৬)।

ﻭﻻ ﻳﺸﺮﻙ ﺑﻌﺒﺎﺩﺕ ﺭﺑﻪ ﺍﺣﺪﺍ ‏( ﺍﻟﻜﻬﻒ )

এবং সে যেন আপন প্রতিপালকের ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে” (আলকোরান, সূরা আহকাফ, আয়াতঃ ১১০)।

পবিত্র কোরআনের এই আয়াত গুলোতে যেহেতু আল্লাহর ইবাদতে অন্য কোনো বস্তুকে শরীক করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেহেতু আমরা কিছুতেই মাইক নামক বস্তুটি ইবাদতে শরীক করতে পারবোনা।

……..আল্লাহর ইবাদতে মাইক ব্যবহার করা কোন ক্রমেই জায়িয নহে বরং ইহা জগন্যতম শিরকের আকবর। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ঢাকা, বাংলদেশ কর্তৃক প্রকাশিত, ২০০৫ শিক্ষাবর্ষের নবম -দশম শ্রেণীর ‘ইসলাম-শিক্ষা’ গ্রন্থের চতুর্থ পৃষ্ঠার শিরক অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে : আল্লাহর ইবাদতে অন্য কোনো শক্তি বা বস্তু শামিল করাও শিরক।” যেহেতু বিদ্যুৎ এক প্রকার শক্তি এবং মাইক বস্তু তাই বর্ণিত দলিল মুত্বাবিক এটা স্পষ্ট শিরক হচ্ছে। নাউযুবিল্লাহ! (ফাতহুল মুবীন, পৃষ্ঠা ১৮-১৯)।

#বিশ্লেষণঃ আল্লাহর ইবাদতে কোনো বস্তুর শরীক বলতে ইবাদতের তিনটি অবস্থাকে বুঝায়।

(১) আল্লাহর পাশাপাশি বা আল্লাহকে বাদদিয়ে অন্য কোন বস্তুর ইবাদত করা।
(২) কোন বস্তুর সাহায্যে বা মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা। এবং
(৩) মানুষকে দেখানোর জন্য ইবাদত করা।

এই তিনটি পয়েন্ট আমি পর্যায়ক্রমে বিস্তারিত আলোচনা করতেছি,

(১) আল্লাহর পাশাপাশি বা আল্লাহকে বাদদিয়ে অন্য কোন বস্তুর ইবাদত করা শিরিক। এটা নিয়ে বুঝাবুঝির কিছুই নেই।
আশা করি যারা ইবাদতে মাইকের ব্যবহার শিরিখ ফতোয়া দিচ্ছেন তাঁরাও বিষয়টি জানেন যে, যারা ইবাদতে মাইক ব্যবহার করতেছে তারা আল্লাহকে বাদদিয়ে বা পাশাপাশি ইবাদত করতেছে না।

বরং (২) কোন বস্তুর সাহায্যে বা মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা ” এই পয়েন্টা ইবাদতে মাইকের ব্যবহার শিরিখ বলে ফতোয়া দেয়ার মূল কারণ। তাই আমি এই পয়েন্টটি বিস্তারিত আলোচনা করতেছি, “কোনো বস্তুর সাহায্যে বা মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা শিরিক ”

এই পয়েন্টটিতে বস্তুর সাহায্যে এবং বস্তুর মাধ্যম মাধ্যম অর্থ : বস্তুর সাহায্য নিয়ে ইবাদতে মাধ্যম সৃষ্টি করা।

বস্তুর সাহায্যঃ যদি একটু ভেবে দেখ তবে দেখবেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইবাদতের সময় আমরা অনেক বস্তুর সাহায্য গ্রহণ করি। যেমনঃ
১/ ঘড়ির সাহায্যঃ ইহা পরোক্ষ সাহায্য। কোরানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

ﺍﻥ ﺍﻟﺼﻠﻮﺓ ﻛﺎﻧﺖ ﻋﻠﻲ ﺍﻟﻤﺆﻣﻨﻴﻦ ﻛﺘﺎﺑﺎﻣﻮﻗﻮﺗﺎ ‏( ﺍﻟﻦ

ﺳﺎﺀ)

নিশ্চয়ই মূমেনদের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে সালাত ফরজ করা হয়েছে। (আলকোরান, সূরা আল নিসা,আয়াত ০৪/১০৩)।

অতএব, বলা যায় নির্দিষ্ট সময়ে সালাত আদায় করা ফরজ। কিন্তু আমরা সালাতের এই গুরুত্বপূর্ণ ফরজ আদায়ের জন্য সূর্যের সাহায্য নিচ্ছি। বর্তমানে ঘড়ির সাহায্য।

২/ আগুনের সাহায্যঃ ইহা প্রত্যক্ষ সাহায্য, দিন শেষে যখন রাত আসে তখন আগুন বা বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে ইবাদত করতে হয়। অন্ধকারে ইবাদত করা ইসলামে অপছন্দনীয়। এভাবে আমরা ইবাদতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অনেক কিছুর সাহায্য গ্রহণ করি। আর আমরা বিশ্বাস করি, এগুলো ইবাদতের উপকরণ। ইবাদতের মাধ্যম নয়।

মাইকও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। তবে আমি একটি বিষয় স্পষ্ট করতে চাই, তা হলো কিভাবে বস্তুর সাহায্যে ইবাদত করলে শিরিখ হয় অথবা কোরানের উপরোক্ত আয়াত গুলো বস্তুর সাহায্যে ইবাদত করা বলতে কি বুঝানো হয়েছে তা।

এই সাহায্যের ধরণ অন্যরকম। যেমন – মক্কার মুশরিকরা যখন আল্লাহর ইবাদত করত তখন তারা আল্লাহর বিভিন্ন নেক্কার বান্দাদের কবর, ছবি, মূর্তি অথবা আল্লাহর কল্পিত ছবি বা মূর্তির সাহায্য গ্রহণ করত। এখানে তারা যাদের বা যেসব বস্তুর উসীলা বা সাহায্য গ্রহণ করত তা ছিল প্রথমত অপ্রয়োজনীয় দ্বিতীয়ত তারা এসব বস্তুকে কেন্দ্র করে কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করত।

এই মুশরিকরা বিশ্বাস করত যে, আল্লাহর নেক্কার বান্দাদের এসব কবর, ছবি, মূর্তি র সাহায্যে বা উসীলায় ইবাদত করলে তারা (নেক্কার বান্দাহগণ) তাদের (মুশরিকদের) কবুলের জন্য সুপারিশ করবে এবং আল্লাহও তা কবুল করে নিবে। কোরানে এভাবেই তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস তুলে ধরা হয়।

ﻭﻳﻌﺒﺪﻭﻥ ﻣﻦ ﺩﻭﻥ ﺍﻟﻠﻪ ﻣﺎﻻﻳﻀﺮ ﻫﻢ ﻭﻻﻳﻨﻔﻬﻢ

ﻭﻳﻘﻮﻟﻮﻥ ﻫﺆﻻﺀ ﺷﻔﻌﺎ ﻭﺀﻧﺎﻋﻨﺪﺍﻟﻠﻪ ﻗﻞ ﺍﺗﻨﺒﻮﻥ ﺍﻟﻠﻪ

ﺑﻤﺎﻻﻳﻌﻠﻢ ﻓﻲ ﺍﻟﺴﻤﻮﺕ ﻭﻻﻓﻲ ﺍﻻﺭﺽ ﺳﺒﺤﻨﻪ ﻭﺗﻌﻠﻲ

ﻋﻤﺎ ﻳﺸﺮﻛﻮﻥ ‏( ﻳﻮﻧﺲ )

তারা আল্লাহকে বাদদিয়ে যে সবের ইবাদত করে, সেগুলো না তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারে, আর না উপকার করতে পারে। তখন তারা বলে, এরা আল্লাহর কাছে আমাদের সাফায়াত কারী। বলুন, তোমরা কি আল্লাহকে এমন বিষয় অবহিত করতে চাও, মহাকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে যে বিষয়ে তিনি জানেন না? তিনি ত্রুটিমুক্ত পবিত্র এবং সেসব থেকে উর্ধ্বে যাদেরকে তোমরা শরীক করতেছে ” (আলকোরান, সূরা ইউনূস, আয়াত :১০/১৮)

 

…… ﻓﺎﻋﺒﺪﺍﻟﻠﻪ ﻣﺨﻠﺼﺎﻟﻪ ﺍﻟﺪﻳﻦ – ﺍﻻﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﺪﻳﻦ ﺍﻟﺨﺎﻟﺺ

ﻭﺍﻟﺬﻳﻦ ﺍﺗﺨﺬﻭﺍﻣﻨﺪﻭﻧﻪ ﺃﻭﻟﻴﺎﺀ ﻣﺎﻧﻌﺒﺪ ﻫﻢ ﺍﻻﻟﻴﻘﺮ ﺑﻮﻧﺎ

ﺍﻟﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﺯﺍﻓﻲ ……… ‏( ﺍﻟﺰﻣﺮ )

সুতরাং আল্লাহর ইবাদত কর বিশুদ্ধচিত্তে, জেনে রাখ, অবিমিশ্রিত আনুগত্য আল্লাহর প্রাপ্য। যাহারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অবিভাবক রূপে গ্রহণ করে (তাহারা বলে), আমরা এদের পূজা এজন্যই করি, এরা আমাদের আল্লাহর সান্নিধ্যে আনিয়া দিবে” (আলকোরান, সূরা যুমারঃ আয়াত ৩৯/২-৩)।

এখন কেউ যদি এরকম ভ্রান্ত আক্বিদা ধারণ করে মাইকের সাহায্যে ইবাদত করে ইবাদতে মাধ্যম বানায়, যে ইবাদতে মাইক ব্যবহার করলে আল্লাহ ভাল শোনতে পাবেন এবং আল্লাহ ইবাদত কবুল করবেন। তবে ইবাদতে মাইক ব্যবহার অবশ্যই শিরিখ হবে। আর এভাবে কোনো বস্তুর সাহায্য নিয়ে আল্লাহর ইবাদতে মাধ্যম সৃষ্টি করে শিরিখ করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন।

আল্লাহ বলেন,

ﻭﺍﻋﺒﺪﻭﺍﺍﻟﻠﻪ ﻭﻻﺗﺸﺮﻛﻮﺍﺑﻪ ﺷﻴﺌﺎ ….. ‏( ﺍﻟﻨﺴﺎﺀ )

আর তোমরা আল্লাহর ইবাদতে কোনো বস্তুকে শরীক করোনা” (আলকোরান, সূরা নিসা, আয়াত ৪/৩৬)।

বস্তুতঃ এরূপ কোনো ভ্রান্ত নিয়ত বা উদ্দেশ্য নিয়ে ইবাদতে মাইক ব্যবহার করা হয়না। বরং অন্যান্য উপকরণের মতোই কেবল মাত্র শব্দের মাধ্যম হিসেবে ইবাদতে মাইক ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া এখানে নিয়ত হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

নবীজি (সা:) বলেছেন, সকল কাজই নিয়তের উপর নির্ভরশীল, প্রত্যেকেই তাই পায় যা সে নিয়ত করে
” (
সহীহ্ আল বোখারি খন্ড নং ০১ হাদিস নং ০১)।

উক্ত হাদিস দ্বারা একথা সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, ইবাদতের সময় সামনে যা কিছুই থাকুক (নিষিদ্ধ জিনিস ব্যতিত যেমনঃ কবর, মূর্তি, ছবি ব্যতিত) কেউ যদি কোনো রকম ভ্রান্ত বিশ্বাস ছাড়া আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইবাদত করে, অবশ্যই তার ইবাদত অন্য কোনো কারণে কবুল না হলে শিরিখ হবেনা।

এরপরও যদি এমন কথা আমাকে বলা হয় যে, রাসূল (সা:) ইবাদতে মাইক ব্যবহার করেননি তাই ইবাদতে মাইক ব্যবহার নাজায়েজ। তবে উত্তরে আমি বলব রাসূল (সা:) তো ঘড়ি দেখে নামাজ আদায় করেনি। তবে ঘড়ি দেখে নামাজ পড়া কিভাবে জায়েজ?

০৩/ রিয়া : অর্থাৎ মানুষকে খুশি করা বা দেখানোর জন্য আল্লাহর ইবাদত করলে তা শিরিখ হবে। কিন্তু আমরা ইবাদতে মাইক ব্যবহার করি মানুষকে খুশি বা দেখানোর জন্য নয় বরং শোনানোর জন্য।

যেমন বক্তা যখন খুতবা দেয় তা সামনের মানুষদের শোনানোর উদ্দেশ্য করে দেয়। ইমাম যখন তাকবীর বলে উচ্চস্বরে তখন মুসল্লীদের শোনানোর উদ্দেশ্য করে বলে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, বক্তা বা ইমাম ঐ মানুষদের ইবাদত করতেছে।

মনে রাখতে হবে যে, রিয়ার ব্যপারটা মানুষের মনের ব্যপার। মানুষ যদি মনে মনে কাউকে দেখানোর জন্য কোনো ইবাদত করে ভেড়ায়, তা হোক মাইক ছাড়া কিংবা মাইক দিয়ে। তা অবশ্যই শিরিখ হবে। কিন্তু এই অদৃশ্য বিষয় নিয়ে কাউকে তাকফির করার অধিকার আমাদের নেই। যেহেতু, কারও মনের খবর আমাদের জানা নেই।

অতএব, বুঝা গেল, ইবাদতে মাইকের ব্যবহারের উপর নয় বরং ইবাদতে মাইক ব্যবহার কারীর নিয়তের উপর ‘রিয়া’ নির্ভর করে।

 

# মাইক ব্যবহার হারাম দলিল : ৬

আল্লাহ বলেন,

ﺍﻥ ﺍﻟﺼﻠﻮﺓ ﻛﺎﻧﺖ ﻋﻠﻲ ﺍﻟﻤﺆﻣﻨﻴﻦ ﻛﺘﺎﺑﺎﻣﻮﻗﻮﺗﺎ ‏( ﺍﻟﻦ

ﺳﺎﺀ )

নিশ্চয়ই মূমেনদের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে সালাত ফরজ করা হয়েছে। (আলকোরান, সূরা আল নিসা,আয়াত ০৪/১০৩)। এ আয়াতে কারীমায় স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সঠিক অর্থে নির্দিষ্ট সময়ে, সঠিক ও সুনিশ্চিত কর্মসূচির মাধ্যমে আল্লাহ পাক একমাত্র মুমিনদের জন্য নামাজ ফরজ করে দিয়েছে। আরবি গ্রামার ও বালাগাতের কায়েদা মতে উক্ত আয়াতে ইহাই প্রমাণিত হয় যে, নামাজের সমস্ত কার্য নামাযীর জন্য খাছ। নামাজের কাজকে মাইকের সাথে মিশ্রিত করা হারাম। কেননা, মাইক নামাজিও নহে এবং ঈমানদারও নহে। (ফাতহুল মুবীন, পৃষ্ঠা নং ১৭-১৮)

#বিশ্লেষণঃ উপরোক্ত আয়াতের যে ব্যখ্যা করা হয়েছে তাতে মনে হয় যেন নামাযের কর্মসূচির (সুন্নত বা নিয়মের) মধ্যে ওয়াজিব, মুস্তাহাব এইরকম কোনো স্তর নেই বরং সবকিছুই ফরজ। যেমনঃ ইক্বামাত দেয়া ফরজ, সানা পড়া ফরজ, টুপি দেয়া ফরজ, আমিন বলা ফরজ ইত্যাদি।

আসলে কি তাই? যদি তাই না হয় তবে, উপরোক্ত আয়াত দ্বারা যে কোনো কর্মসূচির ঘোষণা বা কিভাবে নামাজ পড়বে তার নির্দেশ দেয়া হয়নি তা সুস্পষ্ট। উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সময় মতো নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আর সময় মতো নামাজ পড়া মানে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী অনুসারে নামাজ আদায় করা নয়। যদিও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির মাধ্যমে নামাজ আদায় করা মুমেনদের জন্য উত্তম।

কিন্তু নিজের কল্পনার ভিত্তিতে এর সাথে মাইককে সম্পৃক্ত করা কিছুতেই যৌত্তিক নয়। তাছাড়া, কারও নিজস্ব কল্পনা কোনো কিছু হালাল হারামের কারণ হতে পারেনা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কেউ যদি মনে করে, “মসজিদ একটি পবিত্র স্থান, তাই পা দিয়ে তার উপর হাটা জায়েজ নেই” এই মনে করা কখনো মসজিদে পা দিয়ে হাটাকে নাজায়েজ করেনা।

আরেকটি কথা আবারো উল্লেখ করতেছি, তা হলো, ইবাদতে মাইক কেবল মাত্র ইবাদতের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় ইবাদতের অংশ হিসেবে নয়। তাই নামাযে মাইক ব্যবহার সম্পর্কে “নামাযের কোনো কাজকে ইবাদতের সাথে মিশ্রিত করা হারাম” এ ধরনের কথা সম্পূর্ণ অবান্তর।

#মাইক ব্যবহার হারাম দলিল : ৭

আল্লাহ বলেন,

ﻻﻳﻤﺴﻪ ﺍﻻ ﺍﻟﻤﻄﻬﺮﻭﻥ ‏( ﺍﻟﻮﺍﻗﻌﺔ )

“মুত্বাহিরগণ ছাড়া ওটা (কোরআন) কেউই স্পর্শ করতে পারবেনা” (আলকোরান, সূরা ওয়াকিয়াহ, আয়াত ৫৬/৭৯)। এ আয়াতে স্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, শুধু মাত্র মুত্বাহিরগণ পবিত্র কোরানকে স্পর্শ করতে পারবে। ত্বাহির হল যে নিজে পাক কিন্তু অন্যকে পাক করতে পারেনা,যেমন ফলের রস। আর মুত্বাহিরগণ হলো নিজে পাক এবং অন্যকেও পাক করতে পারে, যেমন নদীর পানি।

আর আগুন বা বিদ্যুৎ মুত্বাহির তো দূরে থাক ত্বাহিরও নয় বরং জাহান্নামের মন্দ বস্তু হতে সৃষ্ট মন্দ বা নাপাক জাহান্নামের বস্তু আগুন অথবা বিদ্যুৎ কি করে অতুলনীয় মহান কোরআনের নূর যাবে? ইহা অসম্ভব। উল্লেখিত পবিত্র কোরআনের আয়াতে কারীমা তারই অকাট্য আজীমুশশান দলিল।

এ জন্য ইমামুল মুফাচ্ছেরিন হযরতুল আল্লামা ঈসমাইল হাক্বী (রা) লিখিত বিশ্ব বিখ্যাত তাফসিরে রুহুল বায়ানে উল্লেখ রয়েছে :”নূর ও আগুন পরস্পর বিপরীত ধর্মী বস্তু। নূরের কাজ হলো আল্লাহর একাত্মতা মেনে নেওয়া এবং আনুগত্য করা। আর আগুনের কাজ হলো শিরিখ করা ইনকার করা”

সুতরাং যান্ত্রিক তথা মাইকের ইবাদত নূরের ইবাদত নয় বরং ইহা জগন্যতম জাহান্নামের মন্দ বস্তু আগুনেরই ইবাদত। পড়ুন নাউযুবিল্লাহ! এ জন্য মুজাদ্দিদে আজম (রা) ইরশাদ করেন, “যত ইবাদত আগুনে হবে শিরিখ হারাম, শিরিখ হারাম। (ফাতহুল মুবীন পৃষ্ঠা নং ১৯-২০)।

#বিশ্লেষণঃ উপরোক্ত আয়াতের সাথে ইবাদতে মাইকের ব্যবহার কতটুকু সম্পর্ক যুক্ত তা পাঠক হয়তো বুঝতে পেরেছেন। খুব আপসোস হয় এমন মূর্খ আলেমদের নিয়ে। যারা নিজের কল্পিত মতের সাথে কোরআনের আয়াত জুড়ে দিয়ে মানুষদের বিভ্রান্ত করতেছে। তাদের কোরআনের আয়াতটির ব্যখ্যা সূচক যে আলোচনা করেছে, তা থেকে আমার মনে কিছু প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। তা হলো,

(ক) আগুন বা বিদ্যুৎ কি জাহান্নাম থেকে সৃষ্ট?
(খ) আগুন কি নাপাক বস্তু?
(গ) আগুনের কাজ কি শুধু ইনকার করা এবং শিরিখ করা?
(ঘ) উক্ত আয়াতে ‘মুত্বাহিরগণ ‘ ও ‘ওহা ‘ শব্দ দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে?
(ঙ) এখানে শিরিখের কথা আসল কিভাবে?

পর্যায়ক্রমে আমি উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিঃ
(ক) আগুন বা বিদ্যুৎ জাহান্নাম থেকে সৃষ্ট কোন বস্তু তা কোরআন হাদিসের কোথাও আছে বলে আমার মনে হয়না। তবে কোরআন হাদীসে উল্লেখ আছে যে, আগুন জাহান্নামীদের শাস্তি দেয়ার উপকরণ গুলোর মধ্যে একটি উপকরণ। আর এই উপকরণ আল্লাহ কোত্থেকে সৃষ্টি করেছেন তা তিনিই ভাল জানেন। তবে ‘আগুন জাহান্নাম থেকে সৃষ্ট ‘ এ ধরনের কথা ভিত্তিহীন অবান্তর কথা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এ পৃথিবীতে আগুনের উৎস হচ্ছে সূর্য। তবে আমরা যে আগুন বা বিদ্যুৎ সরাসরি ব্যবহার করতেছি তা বস্তুর ঘর্ষণের ফলে উত্পন্ন হয়, জাহান্নাম থেকে নয়। মনে রাখবেন, ঠান্ডাও কিন্তু জাহান্নামের উপাদান। ঠান্ডা জাহান্নামও আছে। তাহলে কি বলবেন আইসক্রিম কিঙ্গবা বরফ জাহান্নাম থেকে সৃষ্ট? তাহলে কি আইস্ক্রিম কিংবা বরফ হারাম।  জাহান্নামের ঠান্ডা কিরকম সেটা আমরা জানি না। জাহান্নামের ঠান্ডা আল্লাহ কোথা থেকে সৃষ্টি করেছেন সেটাও আমরা জানি না। ঠিক সেরকম জাহান্নামের আগুন কিরকম সেটা আমরা জানি না, তার সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহ ভালো জানেন।

(খ) ময়লা আবর্জনার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস কি নাপাক? মরা জীবযুক্ত বহমান নদী কি নাপাক?  বাতাসের মতো আগুনও নাপাক হওয়ার কোনো বস্তু নয়। কারণ বাতাসের মত আগুনকেও ধরে রাখা যায়না বলেই নাপাক করা যায়না। সুতরাং, ‘আগুন নাপাক বস্তু’ এ ধরনের কথা ভিত্তিহীন অবান্তর কথা ছাড়া আর কিছুই নয়।

(গ) আল্লাহ তায়ালা কোনো কিছুকেই তার নাফারমানি করার জন্য সৃষ্টি করেনি। বরং নির্দেশ মানার জন্য সৃষ্টি  করেছেন। জ্বীন ও মানুষ ব্যতীত আর কোনো সৃষ্টি-ই তার (আল্লাহর) নির্দেশ অমান্য করেনা। মানুষ  ও জ্বীন নির্দেশ অমান্য করার কারণ, আল্লাহ তাদের স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি দিয়েছেন, যা আগুন বা অন্য কোনো সৃষ্টিকে দেয়নি।

পবিত্র কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী আগুনও আল্লাহর ইবাদত করে, যিকির করে। যার উল্লেখ আছে, সূরা হাদিদের ০১ নং আয়াতে, সূরা হাশরের ০১ নং আয়াতে, সূরা সফের ০১ নং আয়াতে, সূরা তাগাবুনের ০১ নং আয়াতে।

এসব আয়াতে বলা হয়েছে,
ﻳﺴﺒﺢ ﻟﻠﻪ ﻣﺎﻓﻲ ﺍﻟﺴﻤﻮﺕ ﻭﻣﺎ ﻓﻲ ﺍﻻﺭﺽ ‏( ﺍﻟﺘﻎ ﺑﻦ )
মহাকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তাসবীহ করে আল্লাহর “।

সুতরাং, ” আগুনের কাজ শুধু শিরিক করা, ইনকার করা “ এধরনের কথা ভিত্তিহীন অবান্তর কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া আল্লাহ আগুনের মধ্যে যে ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে তা দ্বারা আমরা ভাল মন্দ উভয় কাজ করতে পারি। বিদ্যুতের আগুন তথা মাইক দিয়ে আমরা গান বাজনা শোনতে পারি আবার কোরানও শোনতে পারি। স্বর্ণ ও পানি বিশুদ্ধ করতে পারি আবার আগুন দিয়ে অন্যের ঘরেও জ্বালিয়ে দিতে পারি। সুতরাং আগুন দ্বারা কি কাজ করব সেটা
আমাদের উপর নির্ভর করে, আগুনের উপর নয়। আগুন শুধু আল্লাহর নির্দেশে তার ধর্ম প্রদর্শন করবে। এটাই আগুনের কাজ।

(ঘ) উক্ত আয়াতের ‘মুত্বাহিরগণ’ শব্দ দ্বারা মানুষকে এবং ‘উহা’ শব্দ দ্বারা আপনারা দুনিয়ায় নাযিলকৃত কোরআনকে বুঝিয়েছেন। অনেক তাফসিরগণও এরূপ অর্থ করেছেন। বস্তুত এটি একটি ভুল ব্যখ্যা বা অপব্যাখ্যা। মূলত এই আয়াত বা শব্দ দুটির অর্থ বুঝার জন্য এর পূর্বের দুই আয়াত এবং আয়াতগুলু নাযিলের প্রেক্ষাপট সহ আলোচনা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই আলেমেদ্বীনেরা তা করেনি। বরং ঐ আয়াতটিকে বিচ্ছিন্ন ভাবে আলোচনা করে নিজেদের একটি মতের দলিল বানিয়েছে মাত্র। (আল্লাহ তাদের ভুলটাকে ক্ষমা করুক এবং শুদ্ধটি গ্রহণ করার তাওফিক দান করুক)।

এই পর্যায়ে আমি উক্ত আয়াতের সঠিক মর্ম বুঝানোর চেষ্টা  করতেছি :
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,
ﺍﻧﻪ ﻟﻘﺮﺍﻥ ﻛﺮﻳﻢ – ﻓﻲ ﻛﺘﺐ ﻣﻜﻨﻮﻥ – ﻻﻳﻤﺴﻪ ﺍﻻ
ﺍﻟﻤﻄﻬﺮﻭﻥ ‏( ﺍﻟﻮﺍﻗﻌﺔ )
“নিশ্চয়ই ইহা একটি সম্মানিত কোরআন- যাহা আছে সুরক্ষিত কিতাবে-মুত্বাহিরগণ ছাড়া ওহা কেউ স্পর্শ করতে পারেনা ” (আলকোরান, সূরা ওয়াকিয়াহ, আয়াত: ৫৬/৭৭-৭৯)

উপরোক্ত আয়াত তিনটির শানেনযুল হলো, রাসূলুল্লাহ (সা:) এর উপর যখন কোরআন নাযিল হচ্ছিল, তখন মক্কার কাফের মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ (সা:) এর প্রতি এই অভিযোগ উত্তাপণ করত যে, মুহাম্মদের উপর যা নাযিল হচ্ছে তা শয়তানেরা নাযিল করেন।

তাদের এই অভিযোগের জবাবে আল্লাহ তায়ালা আয়াত তিনটি একসাথে নাযিল করেন। এ আয়াতগুলু
দ্বারা আল্লাহ তায়ালা বুঝাতে চাচ্ছেন, এ কোরআন তিনি এমন এক সুরক্ষিত কিতাবে অর্থাৎ লওহে মাহফুজে সংরক্ষণ করে রেখেছে, যেখানে মুত্বাহিরগণ অর্থাৎ ফেরেস্থাগণ ব্যতীত আর কেউ অর্থাৎ শয়তান রা কখনো এর ধারে কাছেও পৌছাতে পারবেনা। সুতরাং, এই কোরআন শয়তানেরা নাযিল করেন এই ধরনের কথা ডাহা মিথ্যা কথা।

অতএব,
ﻻﻳﻤﺴﻪ ﺍﻻ ﺍﻟﻤﻄﻬﺮﻭﻥ ‏( ﺍﻟﻮﺍﻗﻌﺔ )
“মুত্বাহিরগণ ছাড়া কেউ উহা স্পর্শ করতে পারেনা ” মানে, ফেরেস্থাগণ ছাড়া কেউ লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত কোরানটি স্পর্শ করতে পারেনা। এই আয়াত তিনটির সঠিক মর্ম বুঝার জন্য আপনি ৪৩ নং সূরা আয যুখরুফের ৪ নং আয়াত এবং ৮৫ নং সূরা আল বুরুজের ২১ ও ২২ নং আয়াত পড়ুন।

(ঙ) উপরোক্ত আয়াতের সাথে শিরিখের কি সম্পর্ক তা আল্লাহই ভাল জানেন। এরা প্রায় প্রত্যেক দলিল ব্যখ্যা করার পাশাপাশি শিরিখের বিষয়টি জড়িয়ে দেন। যদিও উপরোক্ত আয়াতের সাথে শিরিখের কোনো সম্পর্ক নেই।
যারা শিরিখ বিষয়ে জানতে চান অর্থাৎ কিভাবে মাইক ব্যবহার করলে ইবাদতে শিরিখ হতে তা জানতে চান, তারা ৪ ও ৫ দলিলের আলোচনা দেখতে পারেন, আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
তাই এখানে আলোচনা করাটা আমি নিষ্প্রয়োজন মনে করি।

# মাইক ব্যবহার হারাম দলিল : ৮

আল্লাহ বলেন,
“আর আমি জ্বিন ও মানুষকে এই জন্য সৃষ্টি করেছি যেন তারা আমারই ইবাদত করে ” (আলকোরান, সূরা আল যারিয়াত, আয়াত নং ৬১/৫৬)

এ আয়াতে স্পষ্ট প্রমাণিত যে, ইবাদত শুধু মাত্র (ঈমানদার) মানব ও দানবের জন্যই খাছ। মাইক যেহেতু ঈমানদার মানব ও দানব নহে সেহেতু মাইকের মাধ্যমে নামাজ পড়া বা অন্যকোন ইবাদত করা জায়িয নহে। মুয়াজ্জিন বা ইমাম সাহেব যখন আল্লাহু আকবর বলেন মাইকও আল্লাহু আকবর বলে। …….(ফাতহুল মুবীন, পৃষ্ঠা নং ১৮)

#বিশ্লেষণঃ এক কথায় এখানে মাইক ঈমানদার মানব ও দানব না হওয়ায় মাইকের মাধ্যমে ইবাদত করাকে হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছে। এটা কে বলেছে যে, মানব ও দানব (জ্বিন) জাতি ব্যতীত আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টি তার ইবাদত করেনা। মাইক ঈমানদার বস্তু কিনা সেটা আমার জানা নেই। কোরআনও এই ধরনের কোনো কথা আলোচনা করেনি। এটা আলোচনা করার কোনো বিষয়ও নয়। তবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে, শুধু মাত্র মানুষ ও জ্বিন জাতিকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেনি তা ইতিমধ্যে আমি প্রমাণ করেছি। (দেখুন, ৭ নং দলিলের ‘গ’ আলোচনা)

আমরা জানি আল্লাহ পাক ফেরেশতা, জিন, মানুষ সহ সকল সৃষ্টিকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টির করেছে। কিন্তুু তার সকল সৃষ্টির মধ্যে একমাত্র মানুষ ও জিন জাতিই নিজেদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য ভুলে যায়। তাই আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে তাদের নির্দিষ্ট করে বলে তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য স্বরণ করিয়ে দিয়েছে। এর মানে এই নয় যে, মানুষ জিন জাতি ব্যতীত আর কোনো কিছুকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেনি। তাছাড়া, মাইক হচ্ছে ইবাদতের উপকরণ যা আমি ইতিমধ্যে আলোচনা করেছি। আর ইবাদতের উপকরণ কখনো ইবাদতের অংশ হতে পারেনা।

# মাইক ব্যবহার হারাম দলিল : ৯

আল্লাহ বলেন,
ﺍﻻﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﺪﻳﻦ ﺍﻟﺨﺎﺍﻟﺺ
“সাবধান! শুধু মাত্র আল্লাহর দ্বীন নির্ভেজাল” (আলকোরান, সূরা আয যুমার, আয়াত ৩৯/০৩)

সুতরাং স্পষ্ট নির্ভেজাল তথা অকৃত্রিম দ্বীন হলো একমাত্র ইসলাম। যা কৃত্রিম তা ইসলাম নয়। বরং নকল ইসলাম হলো ভেজাল দ্বীন তথা শিরক।

সারকথাঃ যেহেতু মাইকের শব্দ বক্তার আসল শব্দ নয় তাই নকল শব্দ শোনে ইবাদত করলে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবেনা। (ফাতহুল মুবীন, পৃষ্ঠা নং ২০-২৪)

#বিশ্লেষণঃ আসল নকল নিয়ে আমি ইতিমধ্যে আলোচনা করেছিলাম। তাই আবার আলোচনা করার
প্রয়োজন মনে করলাম না। এখানে আমি শুধু মাত্র উত্ত আয়াত দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে বা আয়াতটির সঠিক মর্ম কি তা আলোচনা করব ইন শা আল্লাহ।

ﺍﻻﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﺪﻳﻦ ﺍﻟﺨﺎﺍﻟﺺ
“নিঃসন্দেহে, নির্ভেজাল দীন আল্লাহর জন্য ” এর মানে হলো, বিশুদ্ধ বা ইখলাছ যুক্ত ইবাদত কেবল মাত্র আল্লাহর জন্য অন্য কারও জন্য নয়। এখানে দীন শব্দের অর্থ ইবাদত আর খালেছ মানে বিশুদ্ধ, ইখলাছ যুক্ত বা শিরিখ মুক্ত।

আর এই অর্থ তখনই হবে যখন অনুবাদটি এই রকম হবে। কিন্তুু অনুবাদটি যদি এই রকম হয় “আল্লাহর দ্বীন নির্ভেজাল” তবে এই অর্থ বহন করবেনা। সাথে সাথে এর পূর্বের আয়াতের অর্থ এবং উত্ত আয়াতের পূর্ণ অর্থ সৌন্দর্য হারাবে, হারাবে তার মূল অর্থ। তাই অনুবাদকগণ ৩ নং আয়াতের এই অংশটির অর্থ করেছে “নির্ভেজাল দীন আল্লাহর জন্য” উল্লেখ্য দুই অনুবাদই সঠিক কিন্তুু পূর্ণ আয়াতের সঠিক অর্থ ও তাৎপর্য রক্ষা করার জন্য “নির্ভেজাল দীন আল্লাহর জন্য” এই অনুবাদটি গ্রহণযোগ্য।

এবার আসল কথা হলো ইবাদতে মাইক ব্যবহার করাতে কি ইবাদতের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়ে যাবে?

মাইকের শব্দ বক্তার আসল শব্দ নাকি নকল শব্দ এবং তাতে ইবাদতের পরিবর্তন হয় কিনা তা নিয়ে ইতিমধ্যে কয়েকবার আলোচনা করেছি তাই পূণরায় আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করতেছি না। তবে আপনাদের বলে রাখি, যারা ইবাদতের সঠিক অর্থ এবং ইবাদত ও ইবাদতের উপকরণের মধ্যে অথবা উপকরণ ও বিদাতের মধ্যে পার্থক্য বুঝেনা তারাই ইবাদতে মাইক ব্যবহার নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে।

নিচে ইবাদত ও উপকরণের মধ্যে এবং উপকরণ ও বিদাতের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করা হলো।

জেনে নিই ইবাদত ও উপকরণের মধ্যে পার্থক্যঃ
*******************************************

ইবাদত : আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে রাসূল (সা:) এর তরীকা মতে যে কাজ সম্পাদন করা হয় তা ইবাদত।

উপকরণঃ ইবাদত সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্য যা কিছু ব্যবহার করা হয় তাই ইবাদতের উপকরণ।

ইবাদত : ইবাদত উপকরণ নির্ভর নয়।
উপকরণঃ কিন্তুু উপকরণ ইবাদত নির্ভর।

ইবাদত : ইবাদত ইচ্ছাকৃত ভাবে পরিবর্তন বা বাদদেয়া যায়না।
উপকরণঃ উপকরণ ইচ্ছাকৃত ভাবে কিংবা অপ্রয়োজনে বাদদেয়া যায়। তাতে ইবাদতের সওয়াব কমবেশি হয়না।

ইবাদত : ইবাদত কখনো পরিবর্তন বা ভিন্ন হয়না।
উপকরণ : কিন্তুু উপকরণ স্থান, কাল ও পাত্র অনুসারে ভিন্ন হতে পারে।

ইবাদত : নামাজ, আজান, জ্ঞান অর্জন ইত্যাদি।
উপকরণঃ মসজিদ, মিনার ও মাদ্রাসা ইত্যাদি।

জেনে নিই উপকরণ ও বিদাতের মধ্যে পার্থক্যঃ
*****************************************

উপকরণঃ রাসূল (সা:) এর সুন্নত দ্বারা প্রমাণিত ইবাদত সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্য যা কিছু ব্যবহার করা হয় তাই ইবাদতের উপকরণ।
বিদাতঃ রাসূল (সা:) এর সুন্নত দ্বারা প্রমাণিত নয় বরং ইবাদতের নামে তার বিপথগামী উম্মতগণ করে থাকে তাই বিদাত।

উপকরণঃ সওয়াবের নিয়তে ব্যবহার করা হয়না।
বিদাতঃ সওয়াবের নিয়তে করা হয়।

উপকরণঃ সুন্নতের বিপরীত নয়।
বিদাতঃ বিদাত সুন্নতের বিপরীত এবং অতিরিক্ত।

উপকরণঃ গ্রহণ করা জায়েজ।
বিদাতঃ আমল করা নাজায়েজ।

 

মাইক ব্যবহার হারাম এবং মাইক ব্যবহারকারী কাফির মর্মে যারা ফতোয়া দেন তাদের প্রতি একটি হাদিস দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করছি।

কোন মুসলিমকে কাফের বলে অভিহিত করা কবীরা গোনাহ। কারণ রাসূল (সাঃ) বলেন, যাকে কাফের বলা হবে সে সত্যিকারে কাফের না হ’লে যে কাফের বলল তার দিকেই সেটা ফিরে আসবে (তিরমিযী হা/২৬৩৭; বুখারী হা/৬১০৩)

তিনি বলেন, কোন ব্যক্তি কর্তৃক তার (মুসলিম) ভাইকে কাফের বলাটা তাকে হত্যা করার মত অপরাধ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৪১০)

আল্লাহ (সুবহানা ওয়া তাআলাভাল জানেন। আশা করি বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।

 

 

 

কপি রাইট – https://abubakarnetwork.blogspot.com/ ঈষৎ পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত।

 

নতুন জন্ম নিবন্ধন আবেদন প্রক্রিয়া ছবি সহ বিস্তারিত

Exit mobile version